‘পরাণ’, ‘সুড়ঙ্গ’, ‘তুফান’ থেকে ‘তাণ্ডব’—টানা চার বছর ধরে ঈদুল আজহায় সিনেমা নিয়ে আসছেন রায়হান রাফী, সবই আলোচিত। গত বছর আলোচিত তুফান-এর পর এবার তাণ্ডব নিয়ে হাজির শাকিব–রায়হান জুটি। রাফীর অনেক কাজ সত্য ঘটনা অবলম্বনে (‘পরাণ’), অনেক কাজ কেবল প্রধান চরিত্রের জার্নি (‘সুড়ঙ্গ’ ও ‘তুফান’) কিন্তু ‘তাণ্ডব’ কেবল শাকিব খানের একার সিনেমা নয়; বরং এখানে মূল নায়ক গল্প। ঢাকাই ছবির সবচেয়ে বড় তারকা, সঙ্গে একঝাঁক দক্ষ অভিনয়শিল্পীকে সঙ্গে নিয়ে বাণিজ্যিক সিনেমার মোড়কে শক্তিশালী রাজনৈতিক বার্তা দিতে চেয়েছেন তিনি।
একনজরে
সিনেমা: ‘তাণ্ডব’
ধরন: অ্যাকশন, থ্রিলার
রানটাইম: ২ ঘণ্টা ৯ মিনিট
পরিচালক: রায়হান রাফী
চিত্রনাট্যকার: রায়হান রাফী ও আদনান আদিব খান
অভিনয়: শাকিব খান, সাবিলা নূর, জয়া আহসান, আফজাল হোসেন, শহীদুজ্জামান সেলিম, গাজী রাকায়াত
জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায়—এই থিমের সিনেমা আগে অনেক হয়েছে; দু-একটি হয়তো আপনিও দেখেছেন। তবে ‘তাণ্ডব’-এর প্রধান আকর্ষণ এর ব্যাপ্তি। জিম্মি দশা নিয়ে বানানো সিনেমা একের পর এক চমক রেখে যায়, মুক্তির পর সিনেমাটির দর্শকপ্রিয়তার কারণ হয়তো এটাই। তাই সিনেমা শেষ হওয়ার পরেও এর রেশ রয়ে যায়। মনে হয়, অনেকটা ধীরগতিতে এগোনো এ সিনেমা যে সত্যিকারের ‘তাণ্ডব’-এর সূচনা করে গেল, এর শেষ কোথায়? পরিচালক হিসেবে হয়তো এটাই চেয়েছিলেন রাফী।
মুক্তির আগে ফোরকাস্টে শাকিবকে খলনায়ক দেখানো হলেও অনুমান করা গিয়েছিল তাঁর এ অবস্থার পেছনে নিশ্চয় কোনো কারণ আছে। এ ধরনের সিনেমায় এটিই হয়, ‘অতীত’ নায়ককে খলনায়ক বানায়। ‘জীবনের নির্মম সত্যি হলো, প্রত্যেকেরই নিজস্ব কারণ থাকে’, জঁ রনোয়ার ‘দ্য রুলস অব দ্য গেম’ ছবির সেই বিখ্যাত সংলাপ নিশ্চয়ই আপনার মনে আছে। ‘তাণ্ডব’-এও সেটা খোলাসা করা হয়েছে পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানোর মতো করে, আস্তেধীরে।
এবার আসা যাক গল্পে। ‘চ্যানেল বাংলা’ টিভি চ্যানেলে আবহাওয়ার খবর পড়ছিলেন এক সাংবাদিক। এরপর শুরু হয় একজন মন্ত্রীর (ডা. এজাজ) সঙ্গে সাক্ষাৎকার। এর মধ্যেই ভেসে আসে গোলাগুলির শব্দ। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মাঙ্কি মাস্ক পরা একদল মানুষ চ্যানেলটির সব কর্মীকে জিম্মি করে ফেলে। মুখোশধারীদের দলনেতা স্বাধীন (শাকিব খান) লাইভ চলাকালীন গুলি করে বসেন সেই মন্ত্রীকে। এরপর মুখোশ খুলে ক্যামেরার সামনে বলে ওঠেন, ‘লেটস বিগিন দ্য শো... (চলুন, শো শুরু করা যাক)।’ আর এভাবেই চমক দিয়ে শুরু হয় ‘তাণ্ডব’।
এ ঘটনায় নড়ে ওঠে প্রশাসন। দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে পুলিশ, স্পেশাল ‘সোয়াট’ সবাই দ্রুত পরিস্থিতি সমাধান করতে ছুটে যায়। স্বাধীনের কাছে জানতে চাওয়া হয় কী চান তিনি মুক্তিপণ হিসেবে? স্বাধীন চারজন ভিন্ন পেশার ব্যক্তিদের আসতে বলেন। একে একে আসেন ধর্মমন্ত্রী, পুলিশের সাবেক আইজিপি, চ্যানেলের মালিক ও সাংবাদিক।
শুরু হয় এক অভূতপূর্ব সরাসরি সম্প্রচার। একপর্যায়ে যার ভিউ ছাড়িয়ে যায় ১০ কোটি! দেশের সব মানুষের চোখ তখন পর্দায়। সঞ্চালক সাংবাদিক সায়রা (জয়া আহসান)। স্বাধীন শুরু করে তার গল্প। স্বাধীনকে মারতে এগিয়ে যেতে থাকে ‘সোয়াট টিম’। চোখের পলক ফেলার আগে বদলে যেতে থাকে ঘটনার মোড়!
‘তাণ্ডব’-এ রাফী মূলত রাষ্ট্রীয় মদদে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম নিয়ে কড়া বার্তা দিতে চেয়েছেন। সেটা তিনি দিতে পেরেছেন স্বাধীনের গল্প বলেই, এ জন্য আলাদা করে লেকচার দিতে হয়নি। পুরো সিনেমায় উঠে এসেছে সাদাপোশাকে সাধারণ মানুষকে তুলে নিয়ে যাওয়া, আটক না দেখিয়েই রাষ্ট্রীয় বাহিনীর খুন, দুর্নীতিসহ নানা প্রসঙ্গ। সরাসরি নাম প্রকাশ না করেও নির্মাতা তুলে ধরেছেন আয়নাঘরের ভয়াবহতা, সিনেমায় যেটির নাম আয়রন সেল। সিনেমার বেশ কয়েকটি প্রধান চরিত্রের কথা বলা, লুক, মেকআপের সঙ্গে গত সরকারের অনেক মন্ত্রীর ছায়া পাওয়া যায়। সব মিলিয়ে বলা যায়, চলতি বছরের শুরুতে প্রায় একই বিষয়ে নির্মিত ওয়েব ফিল্ম ‘আমলনামা’র পর এটিই রাফীর ক্যারিয়ারের সবচেয়ে রাজনৈতিক কাজ। শাকিব খানেরও নয় কি? ছবিতে মাঙ্কি মাস্ক যেমন আছে, তেমনি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখা যায়, রাস্তায় বানর নাচ দেখাচ্ছে এক ব্যক্তি। সরকার যে দেশের মানুষকে এভাবেই নাচায়, সেটাই কি বোঝাতে চেয়েছেন নির্মাতা?
সিনেমার প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন শাকিব খান। ‘প্রিয়তমা’, ‘রাজকুমার’, ‘তুফান’, ‘দরদ’, ‘বরবাদ’-এর পর এ ছবিতেও ভিন্ন চরিত্র আর ভিন্ন লুকে চমকে দিয়েছেন তিনি। অ্যাকশন দৃশ্য থেকে শুরু করে মরিয়া ‘সন্ত্রাসী’ নেতা কিংবা অন্যায়ের শিকার বেকার তরুণ—সব জায়গাতেই নিজের সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করে গেছেন। এবার আলাদা প্রাপ্তি ছিল শাকিব খানের ভয়েস মডুলেশন। যখন তাঁর স্বর ভেসে আসছিল, হয়ে উঠেছিলেন অন্য এক শাকিব। বেকার স্বাধীন আর জিম্মি–কাণ্ডের হোতা স্বাধীনের কণ্ঠ ও উচ্চারণের এই বদলটা ছিল যথাযথ। সম্ভবত এই প্রথম শাকিবের কণ্ঠ ভিন্নভাবে পর্দায় শোনা গেল।
শাকিব খানের প্রেমিকা নিশাতের চরিত্রে অভিনয় করেছেন সাবিলা নূর। এই ছবি দিয়েই বাণিজ্যিক সিনেমার নায়িকা হিসেবে তাঁর অভিষেক হলো। শাকিবের সঙ্গে সাবিলার রসায়ন ভালোই জমেছিল; তবে পর্দায় তাঁর উপস্থিতি নেহাতই কম। বেকার স্বাধীনের সঙ্গে আবেগের দৃশ্য হোক বা ‘লিচুর বাগানে’ ও ‘তোমাকে ভালোবেসে যেতে চাই’ গানে শাকিব-সাবিলাকে আরও ভালো মানিয়েছে।
সাংবাদিক সায়রার চরিত্রে জয়া আহসান দুর্দান্ত। অসহায়, সাহসী থেকে শুরু করে সব ধরনের দৃশ্যেই তিনি বলেকয়ে ছক্কা হাঁকিয়েছেন। দুই বাংলায় তিনি কেন এত জনপ্রিয়, তা এ সিনেমা দেখলেই বুঝতে পারবেন দর্শক। নায়িকা না হয়েও তিনি এ সিনেমায় যোগ করেছেন নতুন মাত্রা। ধর্মমন্ত্রীর চরিত্রে আফজাল হোসেন, সাবেক আইজিপি চরিত্রে শহীদুজ্জামান সেলিম, টেলিভিশন চ্যানেলটির মালিক হিসেবে ছিলেন গাজী রাকায়েত হোসেন। চরিত্র ছোট হলেও তাঁরা প্রত্যেকেই ভালো অভিনয় করেছেন। সোয়াট টিমের প্রধান হিসেবে পর্দায় উপস্থিতি কম থাকলেও এফ এস নাঈমকে মানিয়েছে ভালো।
আরাফাত মহসীনের আবহসংগীত নিয়ে আলাদাভাবে কথা বলতেই হয়। ‘বরবাদ’-এর পর এ ছবির আবহসংগীতে আবারও নিজেকে প্রমাণ করেছেন তরুণ এই সংগীত পরিচালক। তাঁর কাজ ছবির পুরোটাজুড়ে রোমাঞ্চ ধরে রেখেছে। এ ছাড়া রবিউল ইসলামের লেখা ও মহসীনের গাওয়া ‘খবর দে’ গান পুরো সিনেমায় সৃষ্টি করেছে টানটান উত্তেজনা। তবে এ সিনেমায় গানের ব্যবহার আরও ভালো হতে পারত। ‘লিচুর বাগানে’ ও ‘তোমাকে ভালোবেসে যেতে চাই’ যেন ছবিতে হুট করেই চলে আসে। মোটের ওপর জমজমাট হলেও এ সিনেমায় আরও কিছু খামতি চোখে পড়ে। শাকিব খানের বিপরীতে সোয়াটের এলিট টিমকে মনে হয়েছে ‘নিধিরাম সরদার’। শাকিবের অতীত আর বর্তমান সময়ের লুক ছিল খুব কাছাকাছি; যদিও ঘটনার ব্যবধান আট বছর। বেকার যুবক স্বাধীনের চরিত্রে যে তিনি অভিনয় করছেন, সেটা মাঝেমধ্যেই মানতে কষ্ট হচ্ছিল।
এ সিনেমায় বিভিন্ন চরিত্রকে নানাভাবে যোগ করে গল্পের একটা জাল বোনা হয়েছে। কিন্তু সেটা ভালোভাবে তুলে ধরার জন্য আরেকটু সময়ের প্রয়োজন ছিল। সিনেমার প্রথম দিকে যেভাবে সময় নিয়ে চরিত্র বোনা হয়েছে, সিনেমার শেষ দিকে যেন শুধু তার ব্যাখ্যা দেওয়া হলো। অথচ সিনেমাটি অনায়াসে আরেকটু সময় নিয়ে দেখানো যেত, এতে চরিত্রগুলোও একটু শ্বাস ফেলার সময় পেত।
নির্মাতা যখন রাফী, তখন দর্শকদের প্রত্যাশার পারদও চড়তে থাকে। তাঁরা সিনেমাটি চান আরেকটু পরিণত হোক, আরেকটু ‘যথাযথ’ হোক। এ সিনেমা নিয়েও সে রকম কিছু আক্ষেপ রয়েছে। গল্পে চমক আনতে গিয়ে কখনো কখনো কোনো দৃশ্য দেখানো হয়েছে অসম্পূর্ণ। এতে কিছু জায়গায় খেই হারিয়েছে গল্প। তবে অ্যাকশন, রাজনৈতিক বক্তব্য, বড় তারকাদের অভিনয় মিলিয়ে এটি যে রাফীর ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা কাজ, সেটা বলাই যায়।
রায়হান রাফীর সিনেমা মানেই ওয়ান টেক শট, এ নিয়ে কথা না বললে তাই আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। ‘সুড়ঙ্গ’তে সুড়ঙ্গর ভেতরে ওয়ান টেক শট, ‘তুফান’-এ হাসপাতালের ওয়ান টেক শট অনেক দর্শকেরই মনে থাকার কথা। এ ছবিতেও বিরতির ঠিক আগে চ্যানেলের ভেতরে একটি ওয়ান টেক শট আছে, আরেকটি আছে আয়রন সেল থেকে পালানোর সময়।
আগে নানা ধরনের অ্যাকশন দৃশ্য ঢাকাই সিনেমায় দেখা গেলেও ‘তাণ্ডব’-এর মতো হ্যান্ড টু হ্যান্ড কমব্যাট আগে দেখা যায়নি। বিশেষ করে আয়রন সেলের ওয়ান টেক অ্যাকশন দৃশ্যটি আপনাকে পার্ক চান-উকের ‘ওল্ডবয়’ সিনেমার সেই বিখ্যাত করিডর দৃশ্যের কথা মনে করাবে। এ জন্য অ্যাকশন কোরিওগ্রাফাররা আলাদা ধন্যবাদ পাবেন। তাহসিন রাহমানের সিনেম্যাটোগ্রাফিও ছিল ভালো, বিশেষ করে কিছু দৃশ্যে হ্যান্ডহেল্ড ক্যামেরার দারুণ ব্যবহার আছে।
অতিথি চরিত্রে চমক (এই অংশে স্পয়লার আছে, সিনেমা না দেখে থাকলে এড়িয়ে যাওয়াই ভালো)
সিনেমার সবচেয়ে বড় চমক অতিথি চরিত্রে আফরান নিশো ও সিয়াম আহমেদ। বড়লোকের বখে যাওয়া ছেলের চরিত্রে সিয়াম আহমেদ দুর্দান্ত করেছেন। তাঁর ভয় ধরানো চাহনি আর খ্যাপাটে হাসি শুনে গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল। আফরান নিশো পর্দায় ফিরে এসেছেন অতীত থেকে, সুড়ঙ্গ সিনেমার মাসুদ হয়ে। তবে অতীত থেকে এসেও তিনি ভবিষ্যতে থাকার ইঙ্গিত দিয়ে গেলেন। তুফান-এর শেষে যেমন সিকুয়েলের ইঙ্গিত আছে, এ সিনেমাতেও সেটা আছে। আর আছে সিনেম্যাটিক ইউনিভার্সের ইঙ্গিত। যেখানে হয়তো স্বাধীনের (শাকিব খান) সঙ্গে মাসুদের (আফরান নিশো) টক্কর হবে। সেখানে কোন ভূমিকায় থাকবেন সিয়াম? নাকি সিয়ামকে কেন্দ্রে রেখে আগে আরেকটা ছবি হবে? এসব প্রশ্নের উত্তর না হয় ভবিষ্যতের জন্যই তোলা থাক।
স্বত্ব © ২০২৫ মন্তব্য