লেখা: বাহাউদ্দিন আহমেদ
বাংলাদেশে দ্রুতগতির ইন্টারনেট সেবা আনতে স্টারলিংকের উদ্যোগ নিয়ে সম্প্রতি বেশ আলোচনা চলছে। ইলন মাস্কের মালিকানাধীন স্পেসএক্সের এই অঙ্গপ্রতিষ্ঠানটি স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ইন্টারনেট সেবা প্রদান করে। প্রচলিত ইন্টারনেট অবকাঠামোর বাইরে গিয়ে দূরবর্তী ও দুর্গম এলাকাগুলোতে উচ্চগতির সংযোগ নিশ্চিত করাই স্টারলিংকের মূল লক্ষ্য। সরকারের সঙ্গে স্টারলিংকের প্রতিনিধিদের একাধিক বৈঠকের পর বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) একটি খসড়া গাইডলাইন প্রকাশ করেছে, যা নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা ও সমালোচনা চলছে।
প্রকাশিত খসড়া গাইডলাইনে স্টারলিংকের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বেশ কিছু শর্ত আরোপ করা হয়েছে। জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে সরকারের নির্ধারিত কর্তৃপক্ষ, যেমন ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি), যে কোনো সময় কোম্পানির তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করতে পারবে। পাশাপাশি, সরকারের বিভিন্ন আইন ও বিধিবিধান মেনে চলতে হবে, যার মধ্যে রয়েছে ২০০১ সালের টেলিযোগাযোগ আইন, ১৯৩৩ সালের ওয়্যারলেস টেলিগ্রাফি আইন, ১৮৮৫ সালের টেলিগ্রাফ আইন এবং সাম্প্রতিক সময়ে সমালোচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, যা বর্তমানে সাইবার নিরাপত্তা আইনে রূপান্তরিত হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব শর্তের মাধ্যমে সরকারের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সুযোগ রাখা হয়েছে, যা গ্রাহকদের গোপনীয়তা রক্ষার প্রশ্নে বা আড়িপাতার বিষয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
এছাড়া গাইডলাইনে বলা হয়েছে, স্টারলিংককে বাংলাদেশে ব্যবসা পরিচালনার জন্য যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তরে (আরজেএসসি) নিবন্ধিত হতে হবে। বিদেশি প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্টারলিংককে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) নীতিমালা মানতে হবে। লাইসেন্সের জন্য নির্ধারিত ফি গুলোও উল্লেখ করা হয়েছে, যেমন লাইসেন্স আবেদন ফি ৫ লাখ টাকা, অধিগ্রহণ ফি ১০ হাজার ডলার, বার্ষিক নিবন্ধন ফি ৫০ হাজার ডলার এবং বার্ষিক রাজস্ব ভাগাভাগি ৫.৫ শতাংশ। এই খরচ বাড়তি হওয়ায় অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, সাধারণ গ্রাহকদের জন্য স্টারলিংকের ইন্টারনেট সেবা ব্যয়বহুল হয়ে উঠবে এবং এটি মূলত করপোরেট প্রতিষ্ঠান ও বিশেষায়িত ক্ষেত্রের জন্য বেশি কার্যকর হবে।
বিশ্বজুড়ে স্টারলিংক তাদের স্যাটেলাইট পরিষেবার মাধ্যমে দুর্বল নেটওয়ার্কযুক্ত অঞ্চলে দ্রæতগতির ইন্টারনেট নিশ্চিত করেছে। স্টারলিংকের ইন্টারনেট সংযোগের জন্য সাবমেরিন কেবল বা মোবাইল টাওয়ারের প্রয়োজন হয় না। বরং এটি পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে থাকা হাজার হাজার স্যাটেলাইটের মাধ্যমে সংযোগ স্থাপন করে। বর্তমানে স্টারলিংকের ৬৯৯৪টি স্যাটেলাইট পৃথিবীর কক্ষপথে রয়েছে এবং তারা আরও স্যাটেলাইট পাঠানোর পরিকল্পনা করছে। অন্যান্য দেশে স্টারলিংকের ইন্টারনেট গতি প্রতি সেকেন্ডে ১০০ থেকে ১৫০ মেগাবিটের মধ্যে থাকলেও বাংলাদেশে পরীক্ষামূলকভাবে কী ধরনের গতি পাওয়া যাবে, তা নিয়ে এখনো কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রকাশ হয়নি।
স্টারলিংক বাংলাদেশে এলে গ্রাহকরা উচ্চগতির ইন্টারনেট সেবা উপভোগ করতে পারবেন, বিশেষত যেসব এলাকায় প্রচলিত ব্রডব্যান্ড ও মোবাইল নেটওয়ার্ক পৌঁছায়নি। এতে গ্রাম ও শহরের মধ্যকার ডিজিটাল বৈষম্য কমার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া দুর্যোগের সময় যোগাযোগ ব্যবস্থা সচল রাখা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও উদ্ধার কার্যক্রমের জন্য এটি কার্যকর হতে পারে। তবে এই সেবার উচ্চমূল্য সাধারণ মানুষের জন্য এটি সহজলভ্য করবে না, যা স্টারলিংকের ব্যাপক বিস্তারে একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
এদিকে, খসড়া গাইডলাইনে অন্তর্ভুক্ত নজরদারি ও আড়িপাতার সুযোগ নিয়ে প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে সরকারবিরোধী আন্দোলনের সময় ইন্টারনেট শাটডাউনের ঘটনা আলোচনায় আসে। বিগত সরকার আন্দোলন দমন করতে কয়েকবার দেশজুড়ে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল, যা স্বাধীন মতপ্রকাশের ওপর সরাসরি হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখা হয়। বর্তমান অন্তর্র্বতী সরকার জানিয়েছে যে তারা সাইবার নিরাপত্তা আইন পর্যালোচনা করবে এবং ইন্টারনেট শাটডাউন প্রতিরোধে কাজ করবে। স্টারলিংকের ক্ষেত্রে গোপনীয়তা ও স্বাধীন ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ কতটা বজায় থাকবে, তা নিয়ে এখনো অনিশ্চয়তা রয়েছে।
স্টারলিংক বাংলাদেশে প্রবেশ করলে ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পাবে। বর্তমানে দেশে নির্দিষ্ট কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ইন্টারনেট সেবা সরবরাহের ক্ষেত্রে একচেটিয়া বাজার গড়ে তুলেছে। স্টারলিংক কার্যকর হলে বাজারে নতুন প্রতিযোগিতা তৈরি হবে, যা ইন্টারনেটের মানোন্নয়ন ও খরচ কমাতে ভূমিকা রাখতে পারে। তবে সরকারের কঠোর বিধিনিষেধ ও নজরদারির শর্ত স্টারলিংকের বাংলাদেশে কার্যক্রম শুরুতে প্রভাব ফেলতে পারে। সরকার যদি কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে, তাহলে ভবিষ্যৎতে স্টারলিংক বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী থাকবে কি না, সেটিও বিবেচনার বিষয়।
বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে সরকারের নীতিমালা ও নতুন প্রযুক্তির গ্রহণযোগ্যতার ওপর। স্টারলিংক যদি সত্যিকার অর্থে স্বাধীনভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে, তবে এটি দেশের প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও ডিজিটাল সংযোগের ক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে পারে। তবে সরকারি নীতিমালার সীমাবদ্ধতা ও মনোপলি ব্যবসার চাপের মধ্যে স্টারলিংক কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
স্বত্ব © ২০২৫ মন্তব্য